কেমন সমাজ, ধর্ষকরা এতোটা শক্তিশালী কেনো?
ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে যখন স্কুলের বাচ্চারা রাজপথে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড ধরে থাকে এবং সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকে ধর্ষকদের ফাঁসি চাই, তখন এই সমাজের একজন নাগরিক হিসেবে দম বন্ধ হয়ে আসে। আর একজন মা হিসেবে বুকটা মুচড়ে উঠে, মনে হয় সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজকে তাকে এরকম একটা প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথে দাঁড়াতে হচ্ছে। এই বাচ্চারা ধর্ষণ কী জানে না, অপরাধ কী জানে না, ফাঁসি কী তাও জানে না। এই বয়সে তাদের জানার কথাও নয়। তাদের এ পৃথিবীর সব সুন্দর সুন্দর পশুপাখি, অভয়ারণ্য, আবিষ্কার, গান-বাজনা, রূপকথা, আবিষ্কারের গল্প শুনবে, ছবি আঁকবে, স্বপ্ন দেখবে আকাশ ছোঁয়ার। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস যে আজ তাদের রাস্তায় নেমে দাঁড়াতে হচ্ছে বন্ধুর মৃত্যুর বিচার দাবি করতে।
আমরা জানি মিছিলে, রাজনীতির মাঠে, দাবি আদায়ে শিশুকে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। মিছিল, স্লোগান, প্ল্যাকার্ড বহন এবং ফাঁসির দাবি জানাতে একজন শিশুকে আমরা পথে নামাতে পারি না। কিন্তু, অবস্থা এতোটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে যে আমরা দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে বিচারের দাবি জানাতে শিশুদের ব্যবহার করছি।
এখানেই শেষ নয়। শিশুদের হাতে এমন একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড় করানো হলো, যেখানে লেখা হয়েছে- “আংকেল আমাকে ধর্ষণ করো না।” বিষয়টা চিন্তা করলেও গা গুলিয়ে আসে। শিশুকে আমরা কাকে আংকেল ডাকতে শেখাচ্ছি? একজন ধর্ষক, একজন যৌনপিপাসু দানব, একজন যৌন নিপীড়নকারীকে? একজন ধর্ষক বা যৌন নিপীড়কের কোনো পরিচয় হয় না। তারা কারো বাবা, মামা, খালু, ভাই, দাদা বা চাচা কিচ্ছু নয়। নারী নিপীড়কদের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। তাদের পরিচয় একটাই তারা ধর্ষক ও নিপীড়ক।
ধর্ষক যেই হোক, তাকে শাস্তির আওতায় আনাটাই বড় কথা। যখন একটি দেশে ৬ মাসে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, সেই দেশে ধর্ষণের শাস্তি কী হওয়া উচিৎ তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। নিঃসন্দেহে এই হার আরো অনেক বেশি। এটা শুধু কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য। এই উদ্বেগজনক হারে ধর্ষণ বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধির ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে আতংকিত ও অসহায় করে তুলেছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ নানাভাবে ধর্ষকের বিচার দাবি করছেন।
ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত খবরে দেখলাম ইনজেকশনের মাধ্যমে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিশু ধর্ষণকারীদের যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে দেবে ইউক্রেন। ধর্ষণ ও শিশু নিপীড়নকারী হিসেবে প্রমাণিত হলে ১৮ থেকে ৬৫ বছরের পুরুষের জন্য এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে। ২০১৭ সালে ৩২০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো বলে, যৌন অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর এই আইনটি সেদেশের পার্লামেন্টে পাশ হয়েছে। তারা বলেছে কারাগার থেকে বের হয়ে অপরাধীরা আবার সেই পুরনো অপরাধ করে। ইউক্রেন শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি করা অপরাধীদের একটি কালো তালিকা করবে এবং সরকারের একটি শাখা জেল থেকে বের হওয়ার পর এই অপরাধীদের উপর নজর রাখবে। সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র কাজাখিস্তানেও রাসায়নিকভাবে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করার বিধান আছে।
পাকিস্তানের মতো একটি দেশেও ধর্ষণের শাস্তি জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড করছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকদিন আগে ১০ বছরের এক ছেলে শিশুকে যৌন নির্যাতন ও খুনের অভিযোগে জনসম্মুখে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে ইয়েমেন।
কোনো কোনো অপরাধের মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায় যে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে এবং অপরাধীর জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশেও গত ২/৩ বছর ধরে বিশেষ করে চলতি বছরে ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন এতোটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে মানুষ এর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দাবি করেই যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই পোস্ট দিয়েছেন যে, ধর্ষক যদি ধরা পড়ে. তাহলে তাকে জনসম্মুখে ফাঁসিতে ঝুলানো হোক, তাকে নপুংসক করে দেওয়া হোক, তাদের হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হোক। তীব্র বেদনা ও ক্ষোভ থেকে মানুষ এই দাবিগুলো জানাচ্ছে।
আবার একটু ফিরে আসি শিশু ধর্ষণের এই বাড়াবাড়ি হারের দিকে। বাবা মায়েরা, অভিভাবকরা চিন্তিত তাদেরও ছোট শিশুটিকে নিয়ে, কীভাবে তারা তাদের সন্তানকে আগলে রাখবেন? কারণ চারদিকেই ওৎপেতে আছে মানসিক বিকারগ্রস্ত এইসব দানব। সারাবাংলা অনলাইন নিউজ পোর্টালে উল্লেখ করা হয়েছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশু ধর্ষণের মূল কারণ পিডোফিলিয়া। পিডোফিলিয়া একধরণের অস্বাভাবিক যৌন তাড়না, যারা শিশুদেরকে টার্গেট করে, তাদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক করে আনন্দ লাভ করে। সাধারণত পুরুষরা পিডোফাইল হলেও, নারীরাও পিডোফাইল হতে পারে। তবে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হল, এই পিডোফিলিকদের অধিকাংশই পরিবারের সদস্য বা কাছের আত্মীয়- সংখ্যাগতভাবে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ। যারা বাসায় নিয়মিত আসে এবং যাদের বাসায় যাওয়া হয়।
শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই পিডোফাইলকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে মনোচিকিৎসকরা নির্ণয় করলেও, এর প্রকাশ হয় অপরাধমূলকভাবেই। কাজেই এই অপরাধের শাস্তি যদি কঠোর করা না হয়, তাহলে ক্রমাগত তা বাড়বেই।
সব পক্ষ থেকেই বারবার বলা হচ্ছে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির বিচার হয় না বলেই অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠছে। প্রথম আলো জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮,৬৬৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার এর সূত্র মতে ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সহায়তা নিতে আসেন ২২,৩৮৬ নারী। এরমধ্যে মামলা হয় ৫,০০৩টি ঘটনায়। রায় হয়েছে ৮০২টি ঘটনার। শাস্তি পেয়েছে ১০১ জন। রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ ভাগ আর শাস্তির হার ০.৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর আইন আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধন ২০০৩) অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি (ধারা-৯)
1/ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
2/ একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অন্যূন একলক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
3/ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু আহত হলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
4/ধর্ষণের চেষ্টা করলে অনধিক দশ বছর ও অন্যূন পাঁচবছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
5/পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে ধর্ষণের শিকার হলে অনধিক দশ বছর ও অন্যূন পাঁচবছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
তাহলে কেনো এরপরও অপরাধীর শাস্তি হয় না? কেনো অপরাধীরা পার পেয়ে যায়? ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডাক্তার বিলকিস বেগম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- শারীরিক পরীক্ষা যথাসময়ে না হলে ধর্ষণ প্রমাণ ও বিচার পাওয়া কঠিন। তিনি বলেন, “আইনি লড়াইয়ের জন্য এই সার্টিফিকেটটা খুবই দরকার। এই সার্টিফিকেট না হলে কোনো বিচারই হবে না। ওরা আসতেই দেরি করে ফেলে অনেক সময়। ফাইন্ডিংস আমরা ঠিকমতো পাই না। ঘটনা ওরা স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, সময়টা কিল করে ফেলে। লিডাররা সাত থেকে পনেরদিন পার করে ফেলে। ফলে আমরা ফাইন্ডিংস পাই না।
বিশিষ্ট আইনজীবী সালমা আলী পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিচারহীনতার কারণেই কিন্তু ধর্ষণ আরো বেশি হচ্ছে। বার বার প্রমাণ করতে গিয়ে ভিকটিম দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হয়। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ দেখিয়ে কিছুটা সময় নিতে পারে। কিন্তু, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে মামলা শেষ হতে দশ বছর, বিশ বছরও লেগে যাচ্ছে।” দেশে ধর্ষণের মামলায় বিচারের হার নিয়ে তিনি আরো বলেছেন, “আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি ধর্ষণ মামলায় মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশের শেষ পর্যন্ত সাজা হয়। প্রত্যেকটা জায়গায় একজন মহিলাকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে অথবা একটা কিশোরীকেই প্রমাণ করতে হচ্ছে যে সে ধর্ষিত হয়েছে। আমরা চাই যে আসামিই প্রমাণ করবে যে সে নির্দোষ। রেপ কেসে এইটাই কিন্তু হওয়া উচিৎ।
আমরা ধর্ষণকে ছোট অপরাধ বলে ভাবি বলেই নানা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে অপরাধীরা বেড়িয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই ধর্ষণ হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপ্রকাশিত অপরাধ। প্রায় ৯১.৬ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়, যাকে বলা হয় ‘ডার্ক ফিগারস’- অন্ধকারাচ্ছন্ন তথ্য বা জরিপে উঠে না আসা তথ্য-উপাত্ত।
ধর্ষণের যে বিচার হচ্ছে না এর কারণ হিসেবে ভিকটিম এবং নারী অধিকার কর্মীরা পুলিশের গাফিলতির প্রসঙ্গটি বারবারই সামনে আনে। থানায় মামলা দায়ের থেকে শুরু করে ভিকটিমের সঙ্গে আচরণ, তদন্ত এবং অপরাধীকে গ্রেপ্তার সবক্ষেত্রেই অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।
ধর্ষণ অপরাধীর বিচার করতে হবে দ্রুত বিচার আইনে। প্রমাণসহ, আত্মস্বীকৃত ধর্ষক এবং হাতেনাতে যেসব অপরাধী ধরা পড়ছে, তাদের শাস্তির জন্য তো এতো টালবাহানা, নিয়ম-কানুন ও দীর্ঘসূত্রিতার দরকার নেই। আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে ধর্ষণ নারী বা শিশুর একার সমস্যা নয়, এটা জাতীয় সমস্যা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন জোরেশোরে ধর্ষকের পরিচয় উন্মোচন করতে। আমরা আশা করছি ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরো সহজ করা হবে, যাতে সময়ক্ষেপণের নামে ধর্ষক উড়ে যেতে না পারে এবং আমাদের সন্তানদের আর রাজপথে দাঁড়াতে না হয়।
Comments
Post a Comment